মোঃ রোমান,শেরপুর জেলা
শেরপুরে গতকাল ২৯ আগস্ট ২০২৫, শুক্রবার সন্ধ্যা ৬ টায় উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক সভাপতি, শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক ও মার্কসবাদী চিন্তক অধ্যাপক যতীন সরকার-এর স্মরণ অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী শেরপুর জেলা সংসদ। এ উপলক্ষে উদীচী অফিস কক্ষে আয়োজিত অনাড়ম্বর স্মরণ অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন উদীচী শেরপুর জেলা সংসদের সভাপতি ড. সুধাময় দাস এবং সঞ্চালনায় ছিলেন সাধারণ সম্পাদক শুভজিত নিয়োগী।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই অধ্যাপক যতীন সরকার স্মরনে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। পরে গণসংগীত শিল্পী মুক্তি দত্ত, দেবদাস চন্দ বাবু এবং দেওয়ান মোঃ এনামুল হক “আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে” সংগীতটি পরিবেশন করলে উপস্থিত সকলেই এতে কণ্ঠ মেলান।
সভায় অধ্যাপক যতীন সরকার এর জীবন এবং কর্ম নিয়ে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী শেরপুর জেলা সংসদ এর সভাপতি ড. সুধাময় দাস, সাবেক সভাপতি কবি কমল চক্রবর্তী, সহ-সভাপতি কবি রবিন পারভেজ এবং মোঃ এরশাদ আলী; উদীচী নালিতাবাড়ি উপজেলা সংসদের সাধারণ সম্পাদক কবি মুনীরুজ্জামান; বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির শেরপুর সদর উপজেলা শাখার সভাপতি সুরকার দেবদাস চন্দ বাবু, সাবেক সভাপতি সোলায়মান আহমেদ, নালিতাবাড়ি উপজেলা শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক জনাব জাহীদ হাসান; শেরপুর জেলা নজরুল সংগীত শিল্পী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান মোঃ এনামুল হক; শ্রমিক নেতা স্বপন কর্মকার সহ প্রগতিশীল বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে কবিতা আবৃত্তি করেন কবি কমল চক্রবর্তী এবং সুদীপ্তা দত্ত শ্রেষ্ঠা। তাছাড়া স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কবি রবিন পারভেজ, কবি মুনীরুজ্জামান এবং কবি শুভজিত নিয়োগী প্রমুখ।
অনুষ্ঠানের শেষাংশে গণসংগীত পরিবেশন করেন – মুক্তি দত্ত, দেবদাস চন্দ বাবু এবং মোঃ এরশাদ আলী প্রমুখ।
পরে সভাপতি ড. সুধাময় দাস উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
উল্লেখ্য, অধ্যাপক যতীন সরকারের জন্ম ১৮ আগস্ট ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার চন্দ্রপাড়া গ্রামে। ১৯৫৪ সালে মেট্রিকুলেশন পাশের পর ভর্তি হন নেত্রকোণা কলেজে। পরবর্তীতে আনন্দমোহন কলেজ থেকে স্নাতক এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। কর্মজীবনের শুরুতে ময়মনসিংহের গৌরীপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন, পরে নাসিরাবাদ কলেজের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন তিনি। দীর্ঘ ৪২ বছরের অধিক সময় শিক্ষাকতা পেশায় যুক্ত থেকে তিনি ২০০২ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
অধ্যাপক যতীন সরকার ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হবার পর কমিউনিজমে দীক্ষা নেন এবং একই সময় লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন। কলেজ বার্ষিকীতে প্রকাশিত হয় তার প্রথম লেখা-একটি রম্যধর্মী রচনা। পরে ১৯৬৭ সালে বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ‘পূর্ব পাকিস্তান উপন্যাসের ধারা’ শীর্ষক প্রবন্ধ লিখে “ডঃ এনামুল হক স্বর্ণপদক” লাভ করেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সেপ্টেম্বর মাসে বাধ্য হয়ে ভারতে আশ্রয় নেন এবং মুক্তিযুদ্ধে সংগঠনের বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন তিনি।
নিয়মিতভাবে লেখালেখির সাথে যুক্ত থাকলেও যতীন সরকারের প্রথম গ্রন্থ ‘সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে বলা যায় দীর্ঘ সময় নিয়ে মধ্য বয়স পার করে দিয়ে তিনি প্রাবন্ধিক হিসেবে বাংলা সাহিত্যে নিজের অবস্থান জানান দেন। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় বাংলাদেশের কবি গান, সংস্কৃতির সংগ্রাম, বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য, মানব মন-মানব ধর্ম ও সমাজ বিপ্লব প্রভৃতি গ্রন্থ।
১৯৯৪ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত তাঁর ‘গল্পে গল্পে ব্যকরণ’ – বাংলাদেশের শিশু সাহিত্য এবং ব্যাকরণ গ্রন্থের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
তাঁর রচিত জীবনী গ্রন্থমালার মধ্যে রয়েছে- কেদারনাথ মজুমদার, চন্দ্রকুমার দে, হরিচরণ আচার্য এবং সিরাজউদ্দিন কাশিমপুরী প্রভৃতি। সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী, প্রসঙ্গ মৌলবাদ ও জালাল গীতিকা সমগ্র প্রভৃতি। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- ‘পাকিস্তানের জন্ম মৃত্যু দর্শন’, ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব, নিয়তিবাদ ও বিজ্ঞান চেতনা’, ‘সংস্কৃতি ও বুদ্ধিজীবী সমাচার’ প্রভৃতি।
‘পাকিস্তানের জন্ম মৃত্যু দর্শন’ – গ্রন্থের জন্য ২০০৫ সালে প্রথম আলো বর্ষসেরা গ্রন্থ পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া ২০০৭ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পদক এবং ২০১০ সালে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার “স্বাধীনতা পদক” লাভ করেন। এসবই ছিল লেখক যতীন সরকারের অনবদ্য অর্জন। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি প্রায় ৫০ টিরও অধিক গ্রন্থ রচনা ও সম্পাদনা করেছেন।
কেবল একজন লেখক-বুদ্ধিজীবী হিসেবেই নয়, একজন শিল্প সংগঠক হিসেবেও তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে গেছেন। বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য হবার পাশাপাশি – দু’মেয়াদে উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি হিসেবে বাংলাদেশের প্রগতিশীল আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। তাছাড়া বাংলাদেশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এর বাইরে ময়মনসিংহ নাগরিক কমিটি, মুক্তবাতায়ন পাঠচক্র, বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ ময়মনসিংহ শাখা সহ অসংখ্য সংগঠনের সাথে যুক্ত থেকেছেন।
উদীচী’র এক ক্রান্তিলগ্নে সভাপতির গুরু দায়িত্বভার সামলেছেন অধ্যাপক যতীন সরকার। ২০০১ সালের ত্রয়োদশ জাতীয় সম্মেলন থেকে কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি হন নাট্যব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম। তিনি দেশের বাইরে চলে গেলে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয় জনাব গোলাম মোহাম্মদ ইদু-কে। পরে ২০০৩ সালে চতুর্দশ জাতীয় সম্মেলনে অধ্যাপক যতীন সরকার সভাপতি পদ লাভ করেন এবং পরবর্তী ২০০৬ সালে অনুষ্ঠিত হওয়া পঞ্চদশ জাতীয় সম্মেলনেও সভাপতির দায়িত্ব পেয়ে পরপর দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
কানন আইচ-কে বিয়ে করে অধ্যাপক যতীন সরকার পারিবারিক জীবনে প্রবেশ করেন। তাঁর দুই সন্তান – ছেলে সুমন সরকার এবং মেয়ে সুদীপ্তা সরকার।
অধ্যাপক যতীন সরকার গত ১৩ আগস্ট ২০২৫ মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক সভাপতি, দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবী, মার্কসবাদী গবেষক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক যতীন সরকার-কে আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য।
সত্যেন সেন, কলিম শরফি, পান্না কায়সার, হায়াত মামুদ, সৈয়দ হাসান ইমাম … থেকে যে পতাকা হাতে নিয়ে দুরূহ সময়ে উদীচী’কে এগিয়ে নিয়ে যান অধ্যাপক যতীন সরকার … পরবর্তীতে গোলাম মোহাম্মদ ইদু, কামাল লোহানী, ড. সফিউদ্দিন আহমদ -সহ যারা উদীচী’র এ ধারা কে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, দেশব্যাপী উদীচী’র সচেতন অগনিত কর্মী-সমর্থকেরা নিশ্চয়ই সে ধারা থেকে বিচ্যুত হবে না…